রম্যরচনা
বাঁশ বৃত্তান্ত
Source Link: Prothom Alo
উচ্চশিক্ষার্থে ব্রিসবেন এসে প্রথম যে বাসাটায় থাকতে উঠি সেখানে সবাই ছিলেন বাংলাদেশি। আশপাশের দুই-একটি বাসাতে বসবাররতরাও ছিলেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। প্রথম কয়েকটি দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আর ব্যস্ততায় কেটে গেল। তাই সবার সঙ্গে ঠিক পরিচিত হতে সুযোগ পেলাম না। এরপর ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলাম। পরিচিত হতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, মোটামুটিভাবে সবাই জেনে ফেলেছেন, বাংলাদেশ থেকে নতুন একজন এসেছে। মনে পড়ে, সবার উষ্ণ অভ্যর্থনা আমার ক্লান্তি ও কিছুটা উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করেছিল।
নতুন এসেছি তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘আমি কেমন’ তা জানার আগ্রহ ছিল সবার। কেউ কেউ আমার সম্পর্কে আগে জেনেও ফেলেছিলেন কিছু। যেমন, গম্ভীর, কম কথা বলে, সুন্দর (!) করে কথা বলে…ইত্যাদি! এগুলো কেউ একজন তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে সবাইকে জানিয়েছিলেন। যা আমি পরবর্তীতে ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম। অনেক দিন শিক্ষকতা পেশায় থাকার দরুন বাচনভঙ্গির নমনীয়তা বা দুর্বলতা সবার গোচরীভূত হয়েছিল বলতে হয়! একই সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম, এখানে ছোট্ট একটি বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে যারা অভূতপূর্বভাবে একে অন্যের সঙ্গে কানেকটেড।
অচিরেই ‘সুন্দর করে কথা বলে’ কথাটা, আমার সম্পর্কে মন্তব্যটা যে একটা ‘বাঁশ’ ছিল তা আমি বুঝতে পারলাম। বাংলাদেশে আমার চাকরি জীবনের প্রথম সময়টাতে আমি এই বাঁশ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। আমার এক সহকর্মী তার প্রতিদ্বন্দ্বী সহকর্মীর কোনো একটি অনিষ্ট করে এসে হৃষ্টচিত্তে বলতেন, বাঁশ দিয়ে এলাম। যেমন, প্রতিদ্বন্দ্বী সহকর্মীটির অনুপস্থিতির দরুন তার ক্লাস নিতে গিয়ে কিছু একটা বিগড়ে দিয়ে আসা, কিংবা ভিসি মহোদয়ের কান ভারী করে আসা ছিল একেকটা বাঁশ। প্রথম প্রথম কথাটা কদর্য লাগলেও শ্রদ্ধেয় সহকর্মীটির কর্মতৎপরতা আর একই সঙ্গে কথোপকথনে বারংবার ব্যবহারে ‘বাঁশ দেওয়া’ শব্দটাকে সীমিত পরিসরে আমরা গ্রহণ করেই ফেললাম। নিজে খুব একটা ব্যবহার না করতে পারলেও বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার চারপাশে আইডেনটিফাই করতে পারলাম আর বুঝতে পারলাম বাঁশ দেওয়া কিংবা বাঁশ খাওয়া দুটোই বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। খুব সম্প্রতি রডের পরিবর্তে বাংলাদেশের সরকারি বিল্ডিংয়ে বাঁশের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারছি যে বাঁশ দেওয়াটা ব্যক্তি জীবন থেকে আজ জাতীয় জীবনেও প্রবেশ করেছে!
সে যা হোক, প্রথম প্রথম এই ছোট্ট কমিউনিটিটা আমাকে একটা ফ্রেমে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। নতুন এসেছি, তারা বুঝতে চাচ্ছিলেন আমি লোকটা কেমন! একদিন শুনতে পেলাম, আমি নাকি ‘সিরিয়াস নাঈম ভাই’–এর মতো। জানতে পারলাম, সিরিয়াস নাঈম ভাই হচ্ছেন এখান থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে যাওয়া একজন বাংলাদেশি, যিনি সব সময় সিরিয়াস মুডে থাকতেন। একই সঙ্গে বুঝতে পারলাম, আমার কখনো কখনো হয়তো গম্ভীর আচরণের জন্য তারা আমাকে সিরিয়াস নাঈম ভাইয়ের মতো দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু তা ছাপিয়ে আরও একটি বিষয় বুঝতে পারলাম, কমিউনিটিটা আসলে সিরিয়াস নাঈম ভাইয়ের অভাব বোধ করছে। অনেক দিনের একসঙ্গে থাকার কারণেই হয়তোবা তার চলে যাওয়াতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে আর সবাই চাচ্ছেন সেই শূন্যতাটা পূরণ হোক। ঘটনাটি বুঝতে পেরে সাবধান হয়ে গেলাম। কারও সঙ্গে দেখা হলেই আমি একগাল হাসি দিই, কখনো সখনো অকারণেই হা–হা করে হেসে উঠি। কারণ ‘সিরিয়াস’ তকমায় আমার আপত্তি আছে। এরপর থেকে বোধ হয় একটু গুটিয়ে চলাও শুরু করলাম।
যেই না গুটিয়ে চলা শুরু করেছি, হঠাৎ একদিন একজন ঘোষণা করলেন, আমি হচ্ছি অনুপমের মতো। অনুপম হচ্ছে এখানে পড়াশোনারত একজন বাংলাদেশি যে বেশির ভাগ সময়টাতেই বাসায় থাকে। কোনো আড্ডাবাজি বা নেটওয়ার্কিংয়ে নেই। ছেলেটা বেশ ব্রিলিয়ান্ট, দুই-দুইটা গোল্ড মেডেল সে বাংলাদেশে পড়াকালে পেয়েছে। এই গোল্ড মেডেল নিয়েও আবার কাহিনি। ছেলেপেলেরা দলবেঁধে একদিন জানাল, ওর গোল্ড মেডেল বেঁচে দিয়ে ৭/১১ নামক শপে সবাই একটা কফি পার্টি দেবে। এই তথ্যটা সন্তর্পণে এক কান দু-কান করে আবার তাঁকে জানিয়েও দেওয়া হলো। বাঁশ আরকি! এ রকম বাঁশ অনুপমের বেলায় এত বেশি হলো যে, একসময় সেটাকে একাডেমিক রাইট-আপের ব্যাপ্তির প্যারামিটার ‘সাইটেশন’ হিসেবে উল্লেখ করে গণনা শুরু হলো। বেচারার জন্য দুঃখই হয়। ঘটনা পরম্পরার ভার বহন করতে না পেরে পরবর্তীতে তার একলা জীবন!
যা হোক, এ রকম ছোট বড় অনেক বাঁশ প্রতিনিয়ত আমাদের ভেতর চর্চা করা হয়। এই চর্চার ভেতরে আবার বিভিন্ন রকমফের আছে। যেমন, কেউ কেউ আছেন হাসিমুখে শুধুই বিতর্ক তৈরি করেন। এরপর এক কান থেকে আরেক কান করে বিতর্ক ছড়িয়ে দিয়েই নিজেকে সেফলাইনে রেখে মজা দেখতে থাকেন। বিষয়টা প্রায় সবাই-ই ধরতে পারেন, কেউ কেউ হয়তো পারেন না। কিন্তু, যে বিতর্ক তৈরি হয় তা কিন্তু থামে না। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে একটা জুভিনিল ক্রাইমের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে একটা টার্ম ছিল ‘গুটিবাজি’ বা ‘গুটিবাজ’। আমাদের কমিউনিটি এই হাসি মুখে বিতর্ক তৈরি করা মানুষটির কার্যকলাপ যে গুটিবাজি তা এই গুটিবাজির সংজ্ঞা জানার পরই আইডেনটিফাই করে ফেলল এবং সরাসরি তাকে গুটিবাজ টাইটেল প্রদান করল। মাঝে মাঝে অকেশনালি একজন আবার গুটিবাজি করেন, তাকে সবাই নাম দিলেন কাঠিবাজ। তো যা হোক, পুরো কমিউনিটিতে যারা মূলত বাঁশ আদানপ্রদানে ভূমিকা রাখছেন তাদের যদি একটা বাঁশঝাড় হিসেবে কল্পনা করি তাহলে সবচেয়ে বড় বাঁশটি হচ্ছে ‘শাদ’ (ছদ্মনাম)। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার হাসিখুশি এই ছেলেটাকে দেখলে বোঝাই যায় না, এ বিষয়ে তার কত এলেম। কখনো যদি কোথায় কাউকে বাঁশ দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে তার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে। যা মোটা ফ্রেমের আড়ালেও গোচরীভূত হয় এবং বাঁশ পর্ব শেষে মুখ থেকে তার হাসি দেহে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।
কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বাংলাদেশিরা যেখানেই যান না কেন বাঁশ চর্চা তারা অব্যাহত রাখবেন, অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলা যায়। তবে স্থান ভেদে তার ভিন্নতা আছে যা উল্লেখ্য। আমাদের এখানের চর্চাটা ক্ষতিকর নয় বরং বিশেষভাবে বিনোদনমূলক। শুধুই সহ্য ক্ষমতাটুকু অর্জন করে নিতে হবে। সহ্য ক্ষমতাটুকু যার যত দ্রুত ডেভেলপ করে তিনি হয়তো তত দ্রুত আপন হন, কাছাকাছি আসেন। রুটিন ধরে চলা জীবনের ফাঁকে অলস সময়টুকু এভাবেই সবার আলাপচারিতায় কিছুটা বিনোদনে ভরে ওঠে, যা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে রেখে আসা আপনজনের অভাবটা কিছুটা হলেও পূরণ করে।